পৃথিবীর গভীরে লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত প্রজাতির প্রাণী, যারা জলকণা নয়, বরং আগুনের লাভায় বাস করত। হঠাৎই শুরু হলো মহাবিশ্বযুদ্ধ। রাশিয়া, চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব অগ্রগণ্য দেশগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বজুড়ে। নতুন প্রজন্মের উন্নত অস্ত্রগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, বোমার বৃষ্টি নামায় নীচে থেকে উপরে তুলে। অন্ধকার অগ্নি-উজ্জ্বল মুহূর্তে, পৃথিবীর অনেক জায়গায় আস্ত নগ্ন লালাগোলক বিক্ষিপ্ত হয়; বিশাল বিশাল অগ্ন্যুৎপাতের মতো আগুনের লাভা চেপে ধরে চারপাশ। পর্বতমালার বুক ফেটে পড়ে, সমুদ্রগুলো ফুটে ওঠে একভাবে তীব্র তাপ ও বাষ্পে।

দিগন্ত জুড়ে আগুন আর রক্ত, এমন দৃশ্য যুগে যুগে কোনও মানুষ দেখেনি। শহরগুলো রুদ্ধশ্বাস হয়ে ধসে পড়ছে, নীচে থেকে আসা ধোঁয়া সবদিক অন্ধকারে ঢেকে দিল। হঠাৎ পৃথিবীর গভীর অগ্নিগহ্বর থেকে একটি থरথরে উচ্চস্বরে গর্জন ওঠে। আগুনের মাঝে লালচে শিখার আবরণে ঢাকা বিশালাকার অদ্ভুত প্রাণীগুলো পৃথিবীর উপরের দিকে উঠে আসে। তাদের চোখ দুটো ঝাঁপাঁ করে জ্বলছে, পায়ুপথে আগুন লোন্ডা, গায়ে আগুনের আভা, এমন যে দেখা মাত্রই ভয়ের ছায়া নেমে যায়। এই অগ্নিদেব বা আগুনের দৈত্যদের সামনে দাঁড়িয়ে সাহসী মানুষ-মানুষের গা কাঁপতে থাকে।
বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের কারণে এখন শক্তিশালী দেশগুলো ধ্বংসপ্রায়। যেসব দেশ এতদিন সহজে এই অদ্ভুত প্রাণীদের পরাস্ত করতে পারত, তারাই নীরব বা ধ্বংস হয়ে গেছে। বাদে শুধুমাত্র ক্ষুদ্র-নির্ভর দেশের নাগরিকেরা বেঁচে আছে, তাদেরই এখন এসব অগ্নিপ্রাণীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ফেলতে হবে। প্রত্যেক শহর-গ্রামে ভয়ে বিরক্তি, জমজমাট অসহায় অবস্থা। জনতা বুঝতে পারে, এই প্রাণীর আশ্রয় আর শত্রুতার রহস্য এখনও অনুধাবিত। কেউ বলছে, এক প্রাচীন কিংবদন্তি আছে – পৃথিবীর গভীরে অলিন্দে ভয়ানক আগ্নিদেবের বাস, যারা বিপন্ন সময়ে উঠে আসে মানুষের নাশ করতে। আবার কেউ বলছে, ‘লাভার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে’ তারা উঠে এসেছে।
কিন্তু অর্থাৎ কেউ জানে না ঠিক কী পরিস্থিতি। প্রতিটি দিন মৃত্যুর মুখে, নিহতদের তালিকায় দ্রুত বাড়ছে ছোটো বড়ো সব দেশের মানুষ। শহরছাড়া মানুষের জনজীবন কঠোর যুদ্ধের চেহারা ধারণ করে। অস্ত্রাস্ত্র হাতে বাধয় লোকেরা প্রাণীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। সাঁজোয়া যান, বিমানছবি, মিসাইল আগুনের নয়নে আর মুখোমুখি অভূতপূর্ব অগ্নিদম্পতের মতো রণদৃশ্য সৃষ্টি করেছে। একজন ছোট্ট প্রতিরোধ যোদ্ধা বলল, “আমরা কি সর্বস্ব হারিয়ে গেলাম? এই আগুনদেবের বাহু থেকে কি বাঁচবো কোথায়?” সবাই নির্বাক এই বিপত্তি লড়ছে, ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছে, আবার কিছু সাহসীরা লড়াই অব্যাহত রাখছে।
যুদ্ধের ধোঁয়া জমাট, মুহূর্তে পৃথিবী যেন রক্ত আর আগুনে সেঁকে যাচ্ছে। কিন্তু এত ভয়ের মাঝেও একটুকু আশা ছিল, মানুষ হাল ছাড়ত না। ছদ্মবুদ্ধি নিয়ে কেউ প্ল্যান করছে, বিজ্ঞানীরা ভাবছে কিছু উপায় খুঁজে বের করার। বিশ্বের কোটি কোটি প্রাণ এখন ঝুঁকি নিয়ে নিরাপত্তাহীন। প্রথম পর্ব এখানেই শেষ, আলোচনার শুরু হল কীভাবে শেষ করা যাবে এই ভয়ানক বিপর্যয়…
দ্বিতীয় পর্ব: অগ্নি-চাপগ্রস্ত এই পৃথিবীতে এক বৎসর অতিবাহিত হল ভয়াবহ যুদ্ধে, তখন অবশেষে বেঁচে যাওয়া নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন সবাই মিলে লড়বেন। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দেশের বিজ্ঞানীরা জোট বেঁধেছে। তারা মিল করে এমন এক যন্ত্র বানাতে চায়, যা আবার পৃথিবীর গভীরভাগে সেই অগ্নিপ্রাণীদের ফিরিয়ে পাঠাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, যদি তারা ভূগর্ভস্থ আগ্নেয়গিরির মত বিশাল অগ্নিকুণ্ডে শেষের শ্বাস টেনে নেয়ার মতো কিছু শক্তি প্রয়োগ করতে পারে, প্রাণীদের গ্রাস করে রাখা যাবে।
আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা গড়ে ওঠার সাথে সাথে প্রতিরোধ বাহিনী তৈরি হলো। অনেক দেশের সাবেক সেনা, বীর নায়ক এবং সাধারণ মানুষ এক হয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুতি নিল। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে এক বিশাল পরিষদীতে তারা মিলিত হলো। একজন ধূসরবর্ণের চুল ঢেউখেলানো বিজ্ঞানী ঘোষণা করল, “আমরা যদি এদের প্রকৃত আবাসের কাছে নিয়ে যেতে পারি, এখানে বিদ্যমান অস্ত্র দিয়ে তাদের হারানো সম্ভব। আমরা তৈরি করব একটি বিশাল আদি-কম্পন যন্ত্র।” অন্য কেউ বলল, “এই যন্ত্র ঠেলে দেবে আগুনের একটি মহাসঞ্চালন, যা তাদের মোহিত করে আবার নিচে পাঠাবে।” সবাই চুপচাপ এই আশায় স্তব্ধ।
পরের দিন অরণ্যে (প্রাক্তন শহরের মধ্যে) লুকিয়ে তারা সেটআপ করে বিপুল শক্তির একটি মিশিন। যন্ত্রের নামকরণ হয় ‘অগ্নিপুল’। এর কাজ হবে একটি নির্দিষ্ট স্থানে বিশাল ভূমিকম্প সৃষ্টি করা, যাতে পরিচিত অগ্নিপ্রাণীরা এসে মোহিত হয় সেই কম্পনের দিকে, আর সেখানে দম বন্ধ করে অদৃশ্য হয়ে যায়, গভীর অগ্নিপূর্ণের কোলে ফিরে যায়। কৌশল অদ্ভুত ছিল – ভয়ঙ্কর সস্তন এবং তীব্র কম্পন দিয়ে প্রাণীদের টানে এই ফাঁদ।
এক বিকেলে, অভিযান বলয়ের একদল সাহসী লোক বিমানযোগে প্রচণ্ড আগুনে ভাসমান একটি এলাকায় নেমে পড়ল। যন্ত্রটি চালু হলো, মাথামুণ্ডু কম্পমান ধ্বনি আকাশে ভেসে ওঠল। পৃথিবীর তলা কেঁপে উঠল, গাছপালা দুলতে থাকল। এর সাথে সাথে হঠাৎ হঠাৎ আদিম শাসকের মতো গর্জন আর খাঁখাঁ আওয়াজ পরিবেশ নাড়া দিয়ে গেল। প্রাচীরের ফাটল দিয়ে আগ্নিগর্ভের গর্তের দিকে একের পর এক অগ্নিদেব আকর্ষিত হলো, আস্তে আস্তে তারা দলে দলে সেই যন্ত্রের দিকে আসতে লাগল। খোলা আকাশের নিচে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হলো; বৈদ্যুতিক আলো, অগ্নিসংযোগ এবং শব্দের দম্পতিতে ভয়াল দৃশ্য।
আদিম শক্তির এই সৃষ্টি যখন যন্ত্রের পাশে পৌঁছল, তখনই বঙ্কিমবাণ গান্ধরবশক্তি সক্রিয় হলো। আরেকবার বিশাল কম্পন এলোমেলো হারে। এই কম্পনে প্রাচীণ অগ্নিগর্বগুলো ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটি অগ্নিদেব দুর্ভেদ্য কাঁটা দিয়ে তলিয়ে গেলেন। তাদের ঢাঁড়ি কাঁদছিল, রাগ-বেদনায় করুণ সুর ছড়িয়ে দিচ্ছিল। দ্রুত গর্ত গাঢ় হতে হতে তারা ভিতরের আগুনে হারিয়ে গেলো। কিছুকাল পরে, সেই দম্পতিতে অচেনা সমস্ত রক্তের ক্রন্দন থেমে গেল।
যুদ্ধাকাণ্ডের সেই ভয়ংকর দিন শেষ হল। বিজ্ঞানী এবং বীরেরা বুঝল, ‘অগ্নিপুল’ তাদের বৈজ্ঞানিক প্রাপ্তি সফল হয়েছে। সকল দিন যন্ত্রণায় মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া মানুষ হঠাৎ প্রশান্তি অনুভব করল। পৃথিবীর মাটিতে আগুন আর ধোঁয়ার বদলে ধীরে ধীরে শান্তি নেমে এলো। ক্ষুদ্র ভূপৃষ্ঠে শিশুরা আবার আশার দৃষ্টিতে আকাশ দেখতে পারল, এলোমেলো পাথর আর ধ্বংসাবশেষের মাঝে নতুন গাছ ফুটতে থাকল। মানুষ একসাথে হেসে উঠল, ঝাঁপিয়ে পড়ল একে অন্যকে আলিঙ্গন করতে, প্রার্থনা করল শান্তিপূর্ণ আগামীর।
এই ভাবে, সব দেশ মিলিয়ে তৈরি করা সেই চমৎকার যন্ত্রের সাহসিক যুদ্ধে, পৃথিবীর অগ্নিকায় প্রাণীগুলো আবার নিজের প্রাচীন আগ্নিগর্ভের মধ্যে হারিয়ে গেল। বিশ্ববাসী শিখল, বিশাল বিপদ আসলে ঐক্যবদ্ধ শ্রম আর বিচক্ষণতার মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হয়। তবুও এই দুর্দিন আর কখনো যেন ফিরে না আসে, এটি প্রার্থনা করেই মানুষ ধীরগতিতে পুনর্বাসনের পথ ধরল, আশা নিয়ে ভর করে নতুন যুগের সূচনা করল।
